গল্প ৬, শাহবাগ এবং চাকুরী হারিয়ে ফেলার ইতিহাস


শাহবাগ মোড়

শাহবাগ মোড় দিয়ে প্রতিদিন আমাকে অফিসে আসতে হয়। এই মোড়ে আমি নানান কারনে (অনেক সময় এমনিতেই) যেয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মানুষ দেখতাম। বিশেষ করে হরতালের দিনে কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের কোন বিশাল (সরকারী দল বা অন্য দলের অনুষ্ঠানে) অনুষ্টানের সময় কিংবা কোন দুর্ঘটনার সময় (এই মোড়ে দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণ অকালে ঝরে গেছে), বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অন্দোলনের সময় এই পথ বন্ধ থাকত। আমি লম্বা হেঁটে এই মোড় পার হয়ে আসতাম, আমার হাটা পথে বিশ্রামের জায়গা হত এই শাহবাগ মোড়। নানান কারনে রাস্তা বন্ধের সময় এই মোড়ের চোহারাই আলাদা থাকত। চার রাস্তার মোড়ে অনেকে বসে গান গাইত (এটা বেশি করত ছাত্র/বামদলের লোকজন), পুলিশ এবং র‍্যাব থাকত মোড়ের আইল্যান্ডের উপর। আর টিভি চ্যানেল! কত টিভি চ্যানেল যে এই শাহবাগ থেকে লাইভ দেখিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই! আমি নিজেও একবার সাক্ষাতকার দিয়েছিলাম, প্রচার হয়েছিল কি না জানা নেই!

শাহবাগে যেদিন প্রথম অনলাইন ব্লর্গাসের ব্লগারগন বসেন, সেদিনও আমার একই দশা। আমি মাৎস্য ভবনে নেমে হেঁটে শাহবাগ মোড়ে আসি এবং দেখি গোটা পঞ্চাশেক তরুণ কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই বলে রাজপথ কাঁপাচ্ছেন। রাজাকার, আলবদর, জামায়েত, শিবিরের প্রতি আমার ঘৃনা থাকায় আমিও দাঁড়িয়ে দেখি (মোবাইলে ছবি তোলা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে) এবং গলা মিলাই (আমি ভাল স্লোগান দিতে পারি)। তারপর অফিসে এসে নানান বাংলা বল্গ, ফেইসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি এবং বিকাল নাগাত শাহবাগে অনেক মুক্ত মনের মানুষ জড় হয়ে গলায় গলা মিলান।

তার পরের দিনও আমি হেঁটে শাহবাগ মোড় পার হয়ে আসি (এদিন রমনা পার্কের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছিল) এবং কিছু সময়ের জন্য গলায় গলা মিলাই। এদিন আমার অফিসে আসতে বেশ দেরী হয়ে যায়। অফিসে এসে ঝামেলায় পড়ে যাই (এটা পরে বলছি)! তবে নানা ব্লগে নানান খবর দেখে আমি নিজে কমেন্ট করেছিলাম (উন্মোচনে সহ), সরকার এদের পিটিয়ে নাস্তানাবুদ করে দেবে! কারন আমি তখনো মনে করতাম কাদের মোল্লার ফাঁসি না দেয়া সরকারের ইচ্ছার একটা প্রতিফলন (এই সব ব্যাপার নিয়ে কি বলব। সত্য যারা স্বীকার করেন না তাদের জন্য নালত!) আর এরা সরকারের বিরুদ্বেই আন্দোলন করছে। আমার ধারনা অমুলক হয়ে যায়, নানান স্থান থেকে মুক্ত মনের মানুষ আসতে থাকে এবং একসময় সরকারের ছাত্রলীগ এবং সরকারী দল এই আন্দোলনের পৃষ্টপোষকতা করতে থাকে (যতদুর মনে পড়ে আন্দোলনের ২য় দিন বিকাল থেকেই সরকারের লোকজন আসতে থাকে)। দ্বিতীয় দিন বিকাল থেকে আমি অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম, এই দিনে আমি সরকারের এমপি, মন্ত্রীদের হোটেল রুপসী বাংলার কাছে গাড়ী পার্ক করে সাংগপাংগ নিয়ে হেঁটে আসতে দেখেছি।

যাই হোক, অনেক কথা, অনেক দেখা। প্রায় প্রতিদিন বিকালে বাসায় ফেরার পথে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। স্লোগান শুনেছি, জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে কাদের মোল্লাদের ফাঁসি চেয়েছি। ফাঁকে আরো কিছু কাজ হয়েছে, আমাদের ব্লগারস ফোরাম নামে একটা সংঠন আছে (আমরা শব্দনীড়.কম নামের একটা ব্লগ চালাই এবং আমি এই ফোরামের একজন উপদেষ্ঠা পরিষদের সদস্য হিসাবে আমাদের বন্ধুদের নিয়ে ব্যানার করে এই আন্দোলনের সাথে আমাদের সহমর্মীতা জানাই, এই বিষয়েও একটা বিরাট ব্লগ লিখে ফেলা যায়, আমার শব্দনীড়ের তরুন বন্ধুরাও একটা ইতিহাস করে ফেলছেন, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। শব্দনীড়ে আমার ব্লগে মোবাইলে তোলা শাহবাগের অনেক ছবি আছে) ও তারুন্যের এই দাবী আদায়ের চলতে থাকে। আপনারা অনেকেই অবগত আছেন। শাহবাগ প্রজন্ম চত্ত্বর হিসাবে নাম লিখে ফেলল।

নানান ঘটনার পর সরকারের লোকজন মোটামুটি দাবী মেনে আইন কানুন পরিবর্তন/পাশ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এমন সময় এই তারুন্যের আন্দোলন বিকাল থেকে রাত করার ঘোষনা দিয়ে বাসায় ফেরার কথা ভাবতেই মাথায় বিশাল লাঠির আঘাত পড়ে! আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাবাবাবা নামের একজন ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অনলাইনে এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, লোকজন আবার জড় হতে থাকে। আন্দোলনের কর্মীদের উপর বিশাল চাপ আসে, তাদের আর ঘরে ফেরা হয়ে উঠে না! সেই রাতে আবারো লাগাতার কর্মসুচী চালু হয়। এর পর আবার কত কি হয়ে গেল!

থাবা বাবা নিয়ে আমি একটু সামান্য বলি। উনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে আমি যেহেতু নানান বল্গে ঘুরে বেড়াই তাতে আমি তার নাম (নিক) আগে থেকে জানতাম। ধর্মকারীতে (এই সাইট সকল ধর্ম নিয়েই কথা বলে, নাস্তিকদের মিলনমেলা বলা যায়) আমি মাঝে মাঝে যেতাম এবং থাবা বাবার নুরানীচাপার আমি একজন ফলোয়ার ছিলাম। প্রশ্ন উঠতে পারে আমি কি করে নুরানী চাপার ফলোয়ার হলাম! হা, আমি রেসিপি নিয়ে ওয়ার্ডপ্রেস এ একটা সাইট চালাই দীর্ঘদিন ধরে (ওয়ার্ডপ্রেসে আমার সাইটের জনপ্রিয়তা কম নয়) এবং আমার এই রেসিপি সাইটের জনপ্রিয়তা/হিট বাড়াতে আমাকে অনান্ন্য ওয়ার্ডপ্রেস সাইটের সাথে যোগাযোগ রাখতে হত এবং তাদের ফলো করতে হত, যাদের ওয়ার্ডপ্রেস সাইট আছে তাদেরকে আমি আমন্ত্রন জানাতাম। “অন্যের লেখা না পড়লে, নিজের লেখা পড়বে কে” এই ধারনার কারনে আমি প্রতিদিন অনেক লেখা পড়ি এবং কমেন্ট করি। আবার কিছু লেখা না পড়েও লাইক দিয়ে যাই (কারন উপস্থিতি জানানো) আর এভাবে কি করে নুরানীচাপার ফলোয়ার হয়ে পড়ি (যদিও এখানে দুই একটা লেখা পড়েছি এবং একটা লেখায় ভুলে আমি লাইকও দিয়ে দিয়েছিলাম, পরে সেটা তুলে নিয়েছিলাম, থাবাবাবার শহীদ হবার পরের দিন, তখনো সাইট ওপেন ছিল)।

থাবাবাবা আস্তিক না নাস্তিক ছিল সেটার বিচার মানুষ করতে পারে না। আল্লাহ পরকালে আস্তিক/নাস্তিকের বিচার করবেন বলে আমি মনে করি। দেশের আইন কানুনে এই ধরনের বিচার করা যায় কি না তাও আমার জানা নাই। কিন্তু এইদিকে যে ঘটনা ঘটে গেল আমাদের প্রধানমন্ত্রী থাবাবাবার বাসায় গেলেন (তিনি আমাদের অভিবাবক, তিনি যেতেই পারেন) এবং থাবাবাবার পরিবার সহ ব্লগারদের জানিয়ে দিলেন থাবাবাবার হত্যাকারীদের বিচার হবেই। তার এই যাওয়াটা কেমন যেন লাগল, অনেকের কাছে মনে হল তিনি অভিবাবক হিসাবে সকল মানুষকে সমান ভাবে দেখছেন না। এবং আমি সেইদিন সন্ধ্যায় দৃঢ়ভাবে (যদিও আগে থেকে বলাবলি হচ্ছিলো) শাহবাগে অনেকে বলতে শুনেছি, সরকারই এই আন্দোলনের ইন্দন/রশদ যোগাচ্ছে! সরকারের ইচ্ছায় আন্দোলন চলছে। থাবাবাবার ঘটনায় আসলে আরো দুটি ব্যাপার ঘটে গেল। টেকনিক্যাল নলেজ নাই এমন ব্যক্তি টেকনিক্যাল হয়ে গেল! আর যারা ব্যাপারটা জানতেন তারা নাস্তিকতা অস্বীকার করতে লাগল, মুখে গোলালু দিলেন, সত্য না বলে চুপ থাকলেন। মানে উভয় পক্ষের কাছেই মিথ্যাই দাঁড়িয়ে গেল! কেহ বলল, থাবাবাবার নাস্তিকতার ব্লগ জামাত শিবিরের কাজ, ব্লগে কমেন্ট নাই কেন, হত্যার পর কেন প্রকাশ হল, জামাত শিবিরই থাবাবাবাকে হত্যা করেছে (নানান প্রমান, স্কীনসর্ট হাজির হল) ইত্যাদি ইত্যাদি।

মাঝে একজন বিখ্যাত ব্লগার (যিনি এই আন্দোলনে জড়িত) তার ফেইসবুকে এই হত্যাকান্ডে মেয়ে ঘটিত ক্লু দাড়া করিয়ে ঘুমাতে গেলেন! নেট ও অনলাইনেই দুটো ভাগ হয়ে গেল! এবার বাকী থাকে সরকার! যাদের হাতে এই হত্যাকান্ড কারা ঘটিয়েছে তাদের বের করার কথা, দুঃখের সাথে বলতে হয় সরকার (যারা এখনো শাহবাগ আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চায়) এখনো থাবাবাবার হত্যার রহস্য বের করতে পারে নাই! নাকি বিখ্যাত ব্লগারের কথাই সত্য হিসাবে প্রমানিত হয়েছে বলে সরকার চুপ হয়ে আছেন? আমি মনে করি, ক্ষমতার জন্য রাজনীতি অবশ্যই দরকার কিন্তু এমন রাজনীতি করা দরকার নেই যাতে একটা জাতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারের উচিত এই থাবাবাবার হত্যাকারী যেই হউক না কেন তাদের খুঁজে বের করা এবং চুড়ান্ত শাস্তি প্রধান করা। সত্যতা প্রমানের দায়িত্ব সরকারের।

সে যাই হোক, কত কথা মনে পড়ছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি। শাহবাগ মোড়ের এই আন্দোলনের সাক্ষী হিসাবে একটা কথা না বললেই নয়। যতবারই শাহবাগের মোড়ে গিয়েছি, স্লোগান দিয়েছি, দেখেছি। একটা স্লোগানে এসে নিজকে অপরাধী মনে হয়েছে, এই স্লোগানটা মন থেকে মেনে নিতে পারি নাই। এই স্লোগান এখনো চলে কি করে! ওরা কি বুঝতে পারছে না, এতে আমাদের অন্য ভাইবোনরা কষ্ট পাচ্ছে! অনলাইনে কি শুধুই বাঙ্গালী, শাহবাগে কি আমাদের গারো, মারমা, চাকমা ইত্যাদি ভাই বোন নেই? তুমি কে, আমি কে? বাঙ্গালী বাঙ্গালী! হা, আমি বাঙ্গালী এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের এই বাংলাদেশে শুধু বাংগালী থাকে না, থাকেন আরো অনেক জাতি। প্রকাশ্যে অনেকে মনে কষ্ট পেলেও কিছু বলছেন না/ তেমন করে উঠে আসে নাই। আমি উন্মোচনের একজন নিরন চাকমা (শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন ও তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি প্রসঙ্গ) ভাইয়ের কাছে লজ্জিত। তিনি ব্লগে প্রথম এই কষ্টের কথা আমাদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এখনো চলছে। এতদিন আন্দোলন চালিয়ে যাবার পরও কি তারা তাদের ভুল গুলো শুধরাবেন না! আমার বিনীত অনুরোধ এই স্লোগান বাদ দিন, বিনীতভাবে স্বীকার করুন, বাঙ্গালীর আগে বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি।

যাক, এই আন্দোলন নিয়ে আসলে কয়েক পৃষ্ঠার ব্লগে সব কিছু বলা যাবে না। তবে আমি সবাইকে বলি, আসুন বিবেক খুলি। বিবেক জাগ্রত করি। যেমন বিবেক জাগ্রত করেছেন শিক্ষক আনু মুহাম্মদ। তিনি তার ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমরা আরো শ্লোগান যোগ করতে পারি। যেমন- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: যুদ্ধাপরাধী ছাড়বো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: ধর্ষকদের ছাড়বো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: লুটেরাদের ছাড়বো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: বাংলাদেশ ছাড়বো না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: মালিকানা ছাড়বো না। ‘জবাই করা’, ‘চামড়া তোলা’ ‘নাশতা করা’ মার্কা শ্লোগান আমাদের হতে পারে না। কেউ দিতে চাইলে বলতে হবে: এসব আলবদর সংস্কৃতির শ্লোগান আমরা দিই না।”

আনু স্যার ঠিক বুঝতে পারছেন, একটু ভেবে দেখলে বিষয়টা আমাদের নজরে আসবেই। এই ভীড়েও লুটেরারা লুট করেই চলছে। আস্তিক নাস্তিকের ভীড়ে ওরা ওদের কাজ নিরবে করেই যাচ্ছে! শাহবাগে রাজাকারদের ফাঁসির আন্দোলনের ভীড়ে এইসব টাকার কুমীর/চোরদের আমরা এখনো দেখছি না! আমরা দেশে আসলে যে পরিবর্তনের কথা আশা করি, তরুণ প্রজন্মের জন্য যে জীবন দিয়ে যেতে চাই তার আশার আলোও এখনো দেখা যাচ্ছে না। সেই নেতা, সেই বিবেক কবে দেখব?

গতকাল রাতে মাইনুল এইচ সিরাজী (লেখক/ব্লগার)র ফেইসবুকে একটা স্ট্যাটাস আমার চোখে পানি এনে দিয়েছিল তা হচ্ছে, “হল-মার্ক কেলেঙ্কারি উদঘাটনের জন্য তদন্ত টিম গঠন করে এখন ভালোই বিপদে পড়েছেন সোনালী ব্যাংকের জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজী। দুদকের দায়ের করা ৩৭টি মামলার চার্জশিটে তাঁকে অভিযুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি চাকরি হারাবেন। হারাবেন চাকরিকালীন এবং চাকরি পরবর্তী সুবিধাদি। পথে বসে যাবে তাঁর পরিবার। অথচ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকলে তিনিও পেতেন হাজার কোটি টাকার ভাগ। আমরা আরেকটা বিষয নিয়ে শঙ্কিত। এই ফলাফল তিনি সহ্য করবেন কীভাবে? ইতিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। না জানি আর কী হয়ে যায় তাঁর! আপনারা জিএম সিরাজীর জন্য দোয়া করবেন।” দেখেন আমাদের সুশাসনের নমুনা! যে চুরি ধরিয়ে দিলো সেই হয়ে যাচ্ছে চোর!

শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে আর ভাবতে ইচ্ছা হয় না! যে আন্দোলন আমাদের সমাজে কাঁপন ধরিয়ে দিতে পারত, যে আন্দোলনের কারনে শাসক আর লুটেরায় পরিনত হতে পারত না, যে আন্দোলনের কারনে শাসক জনগণের মঙ্গল করতে প্রস্তুত থাকত, সেটা আর কোথায় হল? তবুও আমি আজো এই ব্লগ পোষ্ট করেই শাহবাগ যাবো। আমাদের সীমিত শক্তি দিয়ে কিছু কথাতো বলতেই হবে।

চাকুরী হারিয়ে ফেলার গল্প

না, এটা সোনালী ব্যাংকের জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজীর গল্প নয়। একান্ত আমার গল্পই। আমার নিজের চাকুরী হারাবার গল্প! শাহবাগ আন্দোলনের ২য় দিনে আমার অফিসে আসতে দেরী হয় (কারন উপরে উল্লেখ করেছি) যথারীতি। বাসে প্রচন্ড ভীড় এবং কাকরাইল মসজিদের কাছে নেমে রমনা পার্কের মধ্যদিয়ে হেঁটে শাহবাগ মোড়ে আসি এবং সেখানে কিছুক্ষন জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেয়া এবং দেখার (খুব একটা বেশি সময় নয়, আমার লেট হয়ে যাচ্ছিলো, সেটাও আমার মাথায় ছিলো)। কোন ফাঁকে আমাদের কোম্পানীর মালিক/ ম্যানেজিং ডাইরেক্টর আমাকে ফোন দেন এবং ভীড়ে ফোন আমার প্যান্টের পকেটে থাকার কারনে আমি ফোনের রিঙ্গার শুনি নাই। মানে আমি উনার ফোন ধরতে পারি নাই!

এদিকে হেঁটে পরিবাগ পার হয়ে আসতে ফোনের রিঙ্গার শুনে পকেট থেকে ফোন বের করি (এর মধ্যে আমি আর ফোন দেখি নাই, শুধু খেয়াল রাখছিলাম ফোন পকেটে আছে কি না!)। এ যে আমাদের একজন উর্ধতন ব্রিগ্রেডিয়ার সাহেব। বুঝতে দেরী হয় না, নিশ্চয় আজ অফিসে নুতন কোন কাহিনী হয়েছে! হা, তিনি আমাকে জানালেন, আমি যেন অফিসে এসেই উনার সাথে দেখা করি। এর পরপর আরো কিছু ফোন এলো জুনিয়র ও সিনিয়র থেকে, মার্কেটিং ডাইরেক্টর থেকেও! আমি কোথায়, আমি কেন ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের ফোন ধরি নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার খবর হয়ে গেল!

অফিসে এসেই সেই ব্রিগ্রেডিয়ার (প্রশাসনিক প্রধান) সাহেবের রুমে প্রবেশ করি! তিনি যা শুনালেন তাতে আমার মাথায় আরো রক্ত উঠে গেল, শরীর হিম হয়ে গেল! আমি যেন আগামী মাস থেকে নুতন চাকুরী দেখে এই কোম্পানী ছেড়ে চলে যাই। আমি ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের ফোন না ধরে বিশেষ বিশেষ অপরাধ করে ফেলেছি! ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সাহেব নিজেই উনাকে বলেছেন আমাকে বাদ দিয়ে দেয়ার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি! তিনি আমাকে শেষ বারের মত সর্তক করে নোটিশ দিয়ে দিলেন। নোটিশ হাতে পেয়ে আমি সত্যই চাকুরী ছেড়ে দেব বলে সিদ্বান্ত নেই। এখানে আর এক মুহুর্ত্ত নয়। আমি আমার টেবিলে যেয়ে বসি এবং রিজাইন লেটার টাইপ করে ফেলি। আগামী ফেব্রুয়ারী ২৮ তারিখ হবে আমার শেষ অফিস! (রিজাইন একসেপ্ট করেছেন ম্যানেজিং ডাইরেক্টর)

আজ ২৪শে ফেব্রুয়ারী। ফেব্রুয়ারী ২৮ আসতে আর মাত্র তিনটে দিন! এখনো আমি জানি না, এর পর আমি কোথায় এবং কি করব! ঢাকা থাকতে পারবো কি না তাও বুঝতে পারছি না! স্ত্রী, সন্তান নিয়ে কি করে কাটবে সময়! বেঁচে থাকার অর্থ কোথায় পাব বুঝতে পারছি না, নুতন কিছু আবার কবে পাব!

শেষ কথা

শাহবাগ আন্দোলন থেকে কে কে পেয়েছে এখনো তা পরিস্কার না হলেও আমার মত অনেকেই নানান গঞ্জনার স্বীকার হয়েছেন এটা সত্য, অনেকের জীবন এলোমেলো। গরুত্বপূর্ন রাস্তা এত দীর্ঘদিন বন্ধের কারনে আমি চাকুরী হারিয়েছি বটে, কেহ কেহ যে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছেন, যানযটে গাড়িতে প্রান হারিয়েছেন এমনও হয়েছে বা হচ্ছে। আমি ভাগ্যবান যে, আমি এখনো বেঁচে আছি!

(সময় পেলে লেখাটা আরো কিছু বড় করা যাবে, কিছু বানান ভুল শুদ্ধ করা যাবে, অনেক কথাই বাদ হয়েছে।)

পুরানো লেখাঃ ফেবুতে ও একটা বাংলা ব্লগে প্রথম প্রকাশ হয়েছিল (ব্লগটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে)। February 25, 2013 ·
লিঙ্কঃ “https://www.facebook.com/udraji/posts/4061425268929

[প্রিয় খাদ্যরসিক পাঠক/পাঠিকা, পোষ্ট দেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। নিম্মে আপনি আপনার মন্তব্য/বক্তব্য কিংবা পরামর্শ দিয়ে যেতে পারেন। আপনার একটি একটি মন্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করে কয়েক কোটি বার। আপনার মন্তব্যের জন্য শুভেচ্ছা থাকল। অনলাইনে ফিরলেই আপনার উত্তর দেয়া হবে।]