গ্যালারি

বিচিত্র পেশাঃ ৫ (নুরু মিয়ার নেহারী রান্না)


[অনেক দিন ধরে ভাবছি, বিচিত্র পেশা নিয়ে সামুতে একটা সিরিজ লিখবো। পথে ঘাটে হাঁটতে গেলে সাধারণত এই ধরনের পেশার মানুষের দেখা মিলে। এই বিচিত্র পেশার মানুষদের সাথে আমি কথা বলে আনন্দ পাই, তাদের ছবি তুলি মোবাইলে। ভাবছি এই মানুষ গুলোকে অনলাইনের পাতায় নিয়ে আসবো। তবে কিছু ভুল করছি, অনেকের নাম, মোবাইল বা ঠিকানা রাখা সম্ভব হলেও তা করতে পারি নাই।]

নুরু মিয়া কুমিল্লা থেকে জীবিকার টানে ছোট বেলায় পুরান ঢাকার লালবাগে আসেন এবং একটা ফুটপাতের দোকানে কাজ জুটিয়ে নেন। কাজ আর কি, বাসি প্লেট ধুয়ে রাখা, এখানে সেখানে খাবার পৌঁছে দেয়া, পানি টানা, দেয়া ইত্যাদি। দোকান মালিক ফুটপাতে চার চাক্কার ভ্যানে হালিম এবং নেহারী বিক্রি করতেন। রাতে রান্না ছাড়াতেন, সারা রাত রান্না হত এবং পরদিন গরম করে বেলা ২টা/৩টা থেকে বিক্রি শুরু হত। এভাবেই নুরু মিয়ার দিন চলছিল।

কালে কালে নুরু মিয়া বড় হলেন, কাজ শিখে গেলেন মানে বাজার করা, রান্না করা এবং সেই রান্না বিক্রি করার কাজটা ধরে ফেলতে পারলেন। এক সময়ে নুরু মিয়া সেই লাল বাগ এলাকাতেই একই রকমের ব্যবসা শুরু করলেন, যেহেতু সবাই তাকে চিনতো, বাকী পেতে ঝামেলা হল না, দিনে বিক্রি করে রাতে টাকা শোধ করতেন। কিছু দিন ভাল ছিলেন, ভাল চলছিল কিন্তু ভাগ্যে না থাকলে যা হয় আর কি! নুরু মিয়া লালবাগের এলাকায় ব্যবসায় চরম মাসুল দিলেন। ব্যবসা ভাল হল না, অনেক টাকা লস দিলেন, দেনা হয়ে পড়লেন, রান্না করা হালিম এবং নেহারী বাসায় ফেরত যেতে লাগল।


এর পর চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন, কিন্তু হাল ছাড়লেন না। নুতন জায়গায় এসে আবারো কম কম পুঁজিতে একই ব্যবসা শুরু করলেন। এবার উপওয়ালা চোখ তুলে তাকিয়েছেন এবং আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হল না। এখন প্রতিদিন তার বিক্রি ১৫/২০ হাজার টাকার মত হচ্ছে, এলাকায় একটা সুনাম হয়েছে। প্রতিদিন তালতলা মার্কেটের গেইটের সামনে দোকান খুলেন দুপুরের দিকে রাত ১১/১২টায় দোকান বন্ধ করেন। নিজ ভাইদেরো একই দোকান দিয়ে বসিয়েছেন। হালিম বা নেহারী (গরুর পায়া দিয়ে রান্না) বা হালিম নেহারী মিক্স যে কাষ্টমার যা চান তাই বিক্রি করেন। নেহারী রান্নাটা জটিল এবং অনেক সময় ধরে রান্না হয় এবং বাসাতেই রান্না করেন এবং বিক্রির সময়ে শুধু নিচে সামান্য আগুন রাখেন যাতে কাষ্টমার গরম গরম খেয়ে শান্তি পায়।


শীত পড়লে ভাল বিক্রি হয় বলে জানালেন। সাধারণত এই নেহারী এই এলাকাতে আর কেহ বিক্রি করেন না, তিনিই একমাত্র আছেন বলে ভাল চলে আর স্বাদের কথা তো আসবেই। স্বাদ না হলে কি আর মানুষ খাবে। পুরা রান্না এবং মশলা পাতি তিনি নিজেই হিসাব করে দেন এবং এজন্য প্রতিদিন রান্নার রঙ ও স্বাদ একই থাকে। একটা নিদিষ্ট পরিমান রান্না করেন সেটা বিক্রি হলেই খুশি থাকেন। খাদ্যে ভেজালের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি জানান, এই একই হাড়ির খাবার আমি নিজেও খেয়ে থাকি, কাজেই ভেজাল কিছু ব্যবহার করি না।

মজার কোন ঘটনা আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি জানান, কিছু মেয়ে কাষ্টমার আছে যারা এসে এমন ঝাল চায় যে তাদের পোড়া গুড়া মরিচ ছিটিয়ে দিতে হয়, এতে এমন ঝাল হয় যে, দেখেই আমি বুঝতে পারি, খেলেই চোখে পানি আসবে অথচ এরা বলে কম ঝাল দিয়েছি!

স্ত্রী, ছেলে মেয়ে ভাই বোন নিয়ে সুখেই আছেন জানালেন। ছবি এবং নেটে প্রকাশের কথা জানিয়ে অনুমতি চাইতেই জানালেন, এই সব বুঝি না, কোন মতে কম দামী একটা মোবাইল চালাই, দেন!

পরিশ্রম সোভাগ্য নিয়ে আসে নুরু মিয়া এই সমাজের উদাহরণ। নুরু মিয়া ব্যবসায় আরো সাফল্য লাভ করবে বলে আমি মনে করি।

বিচিত্র এই দেশ, বিচিত্র এই দেশের মানুষ, কত কি বিচিত্র পেশা! তবে সবই জীবিকার টানে!

বিচিত্র পেশাঃ ৪
http://www.somewhereinblog.net/blog/udraji/30001299

6 responses to “বিচিত্র পেশাঃ ৫ (নুরু মিয়ার নেহারী রান্না)

  1. “পরিশ্রম সোভাগ্য নিয়ে আসে”
    আপনার এই সিরিজ টা নিয়মিত পড়ছি । ভালই লাগছে।
    পরিশ্রমী এইসব মানুষেরা ভালো থাকুক।

    Liked by 1 person

  2. খুব ভাল লাগল

    Liked by 1 person

  3. সামুর লেখাগুলোর লিঙ্ক দিবেন প্লিজ?

    Liked by 1 person

[প্রিয় খাদ্যরসিক পাঠক/পাঠিকা, পোষ্ট দেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। নিম্মে আপনি আপনার মন্তব্য/বক্তব্য কিংবা পরামর্শ দিয়ে যেতে পারেন। আপনার একটি একটি মন্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করে কয়েক কোটি বার। আপনার মন্তব্যের জন্য শুভেচ্ছা থাকল। অনলাইনে ফিরলেই আপনার উত্তর দেয়া হবে।]