গ্যালারি

রেসিপিঃ প্যাঁচানো পরোটা (শান্তিনগর স্পেশাল)


বাংলাদেশে নানান রকমের পরোটা বানানো হয়। বাসা বাড়িতে আমরা যে ভাবে পরোটা বানিয়ে থাকি, সাধারণ বা মাঝারি মানের হোটেলেও সেভাবে বানিয়ে থাকে তবে এক এক হোটেল এক একভাবে কাই তৈরী করে থাকে ফলে স্বাদে অনেক তারতম্য হয়। আমি দেশের নানান আনাচে কানাচের হোটেলে সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে নানান কিসিমের পরোটা খেয়েছি (মোটামুটি একই)। সকালের নাস্তা এবং বিকালের নাস্তা (যদি একটু ভারী খাবার হয়) হোটেলে খাওয়া মানেই হচ্ছে পরোটা দিয়ে কিছু খাওয়া, তবে যারা তেল পছন্দ করেন না তারা এখন নান রুটি খেয়ে থাকেন। যাই হোক, আপনারা জানেন কি না জানি না, ঢাকা শহরে এক সময়ে ফকিরাপুলের কিছু হোটেলের পরোটা দেশ বিখ্যাত ছিল (শুধু চা দিয়েই এই সব পরোটা খাওয়া যেত, পরে মগবাজার মোড়ের হোটেল গুলো ভাল পরোটা বানাত!) তবে এখন আর তা নেই, আগের সেই বিশ্বস্ত হোটেল মালিক নেই, নেই ভাল কারিগর! এখন সবাই কম এবং খারাপ খাইয়ে টাকা রুজি করতে চায়, আর মেহনতি কারিগর সবাই হাত গুটিয়ে ফেলেছেন, হেল্পাররাই এখন কারিগর! আমাদের দেশে হোটেলের রান্না শেখার বিষয়টা হচ্ছে অনেকটা গুরু বিদ্যা। কারোই কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, গুরুর সাথে শিখে যা পারেন। এদিকে জনসংখ্যা বাড়ার ফলে চিপাচাপায় অনেক হোটেল হয়ে গেছে, হেল্পাররা কম শিখেই ভাল বেতনে চাকুরী পেয়ে যাচ্ছে, ফলাফল খাবারের মান ভাল হচ্ছে না! অনেক হেল্পার হোটেলের নাস্তার নিত্য এই পরোটায় কি কি দেয়া হয় তাও জানে না!

বলে নেই, বর্তমানে রাজধানীর শান্তিনগরের বাজারের মোড়ের আশে পাশের কিছু মাঝারি হোটেলে বেশ ভাল পরোটা বানানো হয়। এই পরোটা দিয়ে কাবাব, চিকেন রোষ্ট, গ্রীল চিকেন বেশ মজা করেই লোকজনকে খেতে দেখি! এমন কি শুধু ডালভাজি দিয়েও এই পরোটা গুলো বেশ চলছে। এই হোটেল গুলো এখনো নামই দামী হয়ে উঠে নাই, তবে ভিড়ভাট্টা দেখে মনে হচ্ছে এই হোটেল গুলো আগামীতে নাম কামাবে! আমি মোটামুটি এই শান্তিনগরের সাত আটটা হোটেলের পরোটা খেয়ে দেখেছি! তবে সবার চেয়ে শান্তিনগরের বাজারের মুখের স্বাদ হোটেলের পরোটা বেশ মজাদার বলে আমার মনে হয়েছে। যেমন মোলায়েম, তেমনি স্বাদ। হোটেলটা খুব বেশী দেনের পুরানো নয় এবং ছোট জায়গাতে হলেও সকাল বিকালের ভিড় চোখে পড়ার মত।

প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় তিনজন কারিগর এই হোটেলে শুধু পরোটাই বানিয়ে থাকেন। প্রথমজনের কাজ হচ্ছে পরোটা বেলে প্রথম প্যাঁচ দেয়া, দ্বিতীয়জনের কাজ হচ্ছে মুল পরোটা বেলে তাওয়াতে দেয়া এবং তৃতীয় জনের কাজ হচ্ছে পরোটা ভাজা! কয়েকদিন আগে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখছিলাম। এই দেখা থেকেই পরোটার কারিগর জামাল ভাইয়ের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে যায়। পরবর্তিতে জামাল ভাইএর সাথে এই পরোটা নিয়ে অনেক কথা হয়। জামাল ভাইয়ের কাছে এই পরোটার রেসিপি (রেসিপি শব্দটা বুঝতে পারে নাই, পরে বুঝিয়ে বললাম) জানতে চাইলে প্রথমে রাজী হয় নাই, পরে তাকে জানালাম আমি নিজেও রান্না করি এবং এই পরোটার রেসিপি পেলে আমি বাসায় বানিয়ে খেতাম। এবার জামাল ভাই হেসে বলল, কি কি দিয়ে এই পরোটা বানানো হয়, আমিও টুকে নিলাম, সাথে জামালের ছবিও তুলে নিলাম।

এই হচ্ছে পরোটার কারিগর জামাল ভাই। প্রায় ষোল বছর ধরেই পরোটার ওস্তাদের সাথে পরোটার কাজ শিখেছে এবং এখন নিজেই কারিগর, ভাল বেতনের চাকুরী, এই হোটেলে শুধু পরোটাই বানায়। হাসতে হাসতে বলল, এখন নিজেই ভাল পরোটা বানাতে পারে এবং পরোটার মুল ব্যাপার গুলো অনেক কঠিন, পরোটা ছাড়া আর কিছু করতেও ইচ্ছা হয় না। এই হোটেলের পরোটা খেতে অনেক মানুষ আসে, এটা তার কাছে ভাল লাগে। এবং কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তিনি কখনো খাবারে ভেজাল কিছু দেন না এমন কি সব সময়ে চেষ্টা করেন, খাবার বিশুদ্ধ রাখতে।

যাই হোক, পরোটা কারিগর জামাল ভাইর দেয়া রেসিপি অনুযায়ী কয়েকদিন আগে আমরাও বাসায় এই প্যাঁচানো পরোটা বানিয়েছিলাম। স্বাদ অসাধারণ। আপনারাও মাঝে মাঝে ঘরে এই রেসিপি অনুযায়ী পরোটা বানিয়ে খেয়ে দেখতে পারেন। আমরা সাধারনত বাসায় যে ধরনের পরোটা বানাই অনেকটা সেই রকমেরই! শুধু কাইতে কিছু অতিরিক্ত মালামাল যোগ করতে হবে, প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে, বেলার সময় প্যাঁচানো এবং ভালবাসা! হা হা হা… চলুন দেখে ফেলি।

পরিমান ও উপকরনঃ
– ময়দা, তিন কাপ (মোটামুটি এই তিন কাপে ৭টা পরোটা হবে, চাইলে আপনি বড় পরোটা বানাতে পারেন)
– পাউডারের দুধ, দুই টেবিল চামচ
– ডিম, একটা
– চাপা কলা, একটা (সাগর কলা বা যে কোন বিচি ছাড়া কলা ব্যবহার করতে পারেন)
– তেল, সয়াবিন, চার টেবিল চামচ (আর কিছু তেল ভাজা এবং বেলার জন্য রাখতে হবে)
– চিনি, এক চা চামচ
– লবন, হাফ চা চামচ (তবে কাই বানানো শেষে একটু মুখে দিয়ে দেখবেন, যদি কম মনে হয় সে ক্ষেত্রে লবন পানির সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন, লবন গুড়া দিলে সেটা মেশানো মস্কিল হবে)
– পানি, কুসম গরম পানি থেকে সামান্য বেশি গরম (বেশি গরম পানি দিলে পরোটা মচমচে হবে না, কাই দাঁতে লেগে যাবে)

প্রস্তুত প্রনালীঃ (ছবি কথা বলে!)
পরোটার কাই প্রস্তুত করনঃ

ছবি ১


ছবি ২


ছবি ৩


ছবি ৪


ছবি ৫

পরোটা প্যাঁচানো এবং বেলে নেয়াঃ

ছবি ৬


ছবি ৭


ছবি ৮


ছবি ৯। এই প্যাঁচের জন্যই নাকি এই পরোটার নাম প্যাঁচানো পরোটা।


ছবি ১০


ছবি ১১

পরোটা ভাজাঃ

ছবি ১২


ছবি ১৩


ছবি ১৪


ছবি ১৫

পরিবেশনাঃ

ছবি ১৬। আমি কয়েকটা পরোটা তেল ছাড়া ভেজেছিলাম। পরিবেশনের প্লেটের উপরেরটা তেল ছাড়া ভাঁজা পরোটা। আপনারা আপনাদের ইচ্ছানুযায়ী তেল দিয়ে বা কম তেলে বা হালকা তেলে ভেজে খেতে পারেন।

স্বাদ অসাধারন। মোলায়েম বা তুলতুলে, আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী যে কোন তরকারী দিয়ে খেয়ে পারেন আর তরকারী না হলে নাই, শুধু সামান্য মিষ্টি দেয়া চা দিয়েই এই পরোটা খেয়ে দেখতে পারেন। আশা করি ভাল লাগবে। আমার রান্না চেষ্টার বুলেট খেয়ে প্রশংসা করেছে।

সবাইকে শুভেচ্ছা। হোটেলের খাবার গুলো নিরাপদ ও ভেজাল মুক্ত হউক।

কৃতজ্ঞতাঃ মানসুরা হোসেন এবং পরোটা কারিগর জামাল ভাই

পরোটার আরো রেসিপি দেখে নিতে পারেনঃ
রেসিপিঃ সাধারন পরোটা (সকালের নাস্তায়)
রেসিপিঃ খাস্তা পরোটা / পার্টি পরোটা/ হোটেল পরোটা

16 responses to “রেসিপিঃ প্যাঁচানো পরোটা (শান্তিনগর স্পেশাল)

  1. Apni rannar jonno onak kaj koren!

    Like

  2. ভাই, একেবারে জিভে জল এসে গেল! কতদিন খাইনা এমন মজাদার হোটেল এর পরোটা সবজি। পরোটা তো শিখিয়ে দিলেন ভাই, এবার হোটেল এর সবজিটাও একটু দেখিয়ে দিন দয়া করে। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।

    Like

    • ধন্যবাদ ভাই।
      হোটেলের সবজি রান্নায় আমারও আগ্রহ আছে। দেখা যাক, যদি আগামীতে সুযোগ পাই তবে চেষ্টা করবো। তবে ঘরে একটা মিক্স ধরনের সবজি রান্না করে এই পরোটা দিয়ে চালিয়ে দেখতে পারেন। ভাল লাগবে।
      শুভেচ্ছা। আশা করছি মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবেন।

      Like

  3. porotar upokoron r patch er details dekhte chai

    Liked by 1 person

    • ধন্যবাদ অজ্ঞাত ভাই/বোন।
      সরি ফর লেট। হ্যাঁ, আজ উপকরণটা লিখে দিলাম। হোটেলের কারিগর জামাল যেভাবে পরিমানের কথা বলেছিল, সেটা আমরা মানতে চেষ্টা করেছি। আশা করি এবার একবার এই পরোটা বানিয়ে দেখবেন। প্যাঁচটা হচ্ছে, প্রথম বার বেলে দুইভাগকে এক ভাগে আনতে হবে, এবং এই ভাগকেই প্যাচিয়ে গোল করতে হবে। ছবিতে পরিস্কার বুঝাতে চেষ্টা করেছি, লিখে বুঝানো কঠিন বলে ছবি গুলো সেই মোতাবেক সাজিয়েছি। আশা করি ছবি গুলো দেখে বুঝতে পারবেন।
      শুভেচ্ছা।

      Like

  4. পরোটার বানাতে কী কী উপকরণ লাগে সেটার লিস্ট তো দেন নাই। ছবি দেখে বুঝলাম কলা ডিম দিতে হয়।কিন্তু সেটা কতটুকু আটার জন্য। জানাবেন প্লিজ খেতে চাই এই পরোটা।

    Liked by 1 person

    • ধন্যবাদ কাকা। আপনার কমেন্ট পেয়ে সন্মানিত বোধ করছি। আপনি কেমন আছেন? এখনো কি কোরিয়াতেই আছেন? দেশে কি আর আসবেন না! হা হা হা…

      যাই হোক, রেসিপি লিখার সময়েই উপকরন লিখে ফেলা ভাল, মাঝে মাঝে গাফেলতি করি। এবং পরে আর লিখতে ইচ্ছা হয় না। তবে আমি চাই আমার সব রেসিপি যেমন আমাদের বানানো, তেমনি সব রেসিপিতে উপকরণ ও পরিমানও যেন থাকে। রান্নার সময়েই আমি নোট খাতায় তা তুলে নেই।

      সরি ফর ডিলে। আশা করি দেখে যাবেন। প্যাঁচ টা ছবিতে ভাল দেখাতে পেরেছি। আশা করি পারবেন।

      শুভেচ্ছা থাকলো। আপনাদের উপস্থিতি আমাদের অনুপ্রেরনা।

      Like

  5. ajkei banabo in shaa allah ^_^
    apnar blog ami niyomito pori but kokhono comment kora hoyna..apnar recipe dekhe ami daal shoho onek kisu ranna koresi. alhamdulillah onek moja hoy khabargulo. next week a dherosh vorta korbo in shaa allah 😀
    apnar recipe amar ajonno beshi valo lage j shob ingredient haater kasei thake 🙂 shadharon ingredient diye oshadharon ranna hoye jae :))
    ami baire pora-shona kori. amader moto student der j apni koto boro upokar korsen ta bodh hoy nejeo janen na 😛
    ami amar friend der keo apnar recipe follow korar suggest kori.
    May Allah bless you and your family. -Tayeeba

    Like

    • ধন্যবাদ বোন,
      আপনারা আমার রেসিপি গুলো পছন্দ করেন বলেই আমি আরো সাহসী হই। আমাদের সাধারণ খাবারের ছবি গুলো এক সময়ে ছবি আকারে দিতে অনেকেই লজ্জা পেতেন, এখন আর সেই সমস্যা নেই। আমি এই জাল ভেঙ্গে বের হয়ে আসছি।

      আমি নিজে প্রবাসী ছিলাম, ছাত্রদের মেসে থাকার জায়গায় আমি বহু রাত কাটিয়েছি, আমি এই জীবন দেখেছি। রান্না না জানার জন্য কত কষ্টে জীবন যায় আমি নিজ চোখে দেখেছি। অথচ রান্না কত সহজ কাজ। রান্না জানলে সময়ও কাটে সুন্দর করে, অনেক অযাচিত কাজ থেকেও নিজকে বিরত রাখা যায়।

      আমাদের সময়ে এভাবে ঘুছিয়ে কেহ রেসিপি দিত না। যদিও কিছু পাওয়া যেত তাও ইংরেজীতে এবং ছবি ছাড়া, কোন মতে। যা দেখে রান্না করাতো দূরে থাক, ইচ্ছাও হত না। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।

      আপনাদের দোয়ায় মোটামুটি আমাদের প্রায় সকল খাবার রান্নার রেসিপি দিয়ে ফেলেছি। আমাদের রান্না গুলো দেখে যে কেহই রান্না করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর মশলাপাতিতে আমি আমাদের হাতের কাছে থাকা মশলা গুলো দিয়েই রান্না করি, যাতে একজন নূতন রান্নায় আগ্রহীর কাছে কষ্ট না মনে হয়।

      একবার রান্না শুরু করলেই আমি মনে করি হাত চলে আসবে। আমার চেষ্টা থাকে প্রথম বার একটা আগ্রহ তৈরী করে দেয়ার।

      আপনাকে শুভেচ্ছা। আশা করি আমাদের সাথেই থাকবেন। আপনার বন্ধুদের আমাদের সালাম দিবেন।

      Like

  6. and I’m gonna eat this porota with tea 😀
    recipe dekhar por protidin ami check kortam apni ingredients diyesen kina! haha

    Like

    • ধন্যবাদ বোন,
      মাঝে মাঝে এমন ইচ্ছা করেই করি, যাতে আপনারা আগ্রহ দেখান। হা হা হা। কিন্তু সরি ফর লেট।

      আশা করি একদিন বানিয়ে খাবেন এবং আপনার বন্ধুদের খাওয়াবেন। এই পরোটার সাথে যে কোন একটা মিক্স সবজি বানিয়ে নেবেন।

      শেষে থাকবে গরম গরম চা!

      শুভেচ্ছা।

      Like

  7. পিংব্যাকঃ রেসিপিঃ জিতু পরোটা | রান্নাঘর (গল্প ও রান্না)

  8. আপনার রেসিপি অনুযায়ী পরোটা তৈরি করবো। আচ্ছা এটার কি অন্য নাম লাচ্ছা পরোটা?? এই অসাধারণ রেসিপির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

    Liked by 1 person

  9. ঊদরাজি ভাই, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । আমি এই পরটা বানিয়েছিলাম । খুব আশা নিয়ে খাবো বলে বসেছিলাম । খেতে খুব একটা সুখাদ্য হয় নি। যাক , মনে দুঃখ নেই। অন্য কিছু চেষ্টা করে দেখব। আপনার নিজের রেসেপি গুলো অনেক ভাল হয়।
    আবার ধন্যবাদ ।
    ইফতেখার , টরন্টো।

    Like

[প্রিয় খাদ্যরসিক পাঠক/পাঠিকা, পোষ্ট দেখে যাবার জন্য ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা। নিম্মে আপনি আপনার মন্তব্য/বক্তব্য কিংবা পরামর্শ দিয়ে যেতে পারেন। আপনার একটি একটি মন্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করে কয়েক কোটি বার। আপনার মন্তব্যের জন্য শুভেচ্ছা থাকল। অনলাইনে ফিরলেই আপনার উত্তর দেয়া হবে।]