তেহারী পছন্দ করেন না এমন মানুষ আমাদের এই ঢাকা শহরে (বাংলাদেশেও) পাওয়া দুরহ হবেই। পাশাপাশি প্রায় সকল রাস্তার ধারের টং হোটেলে (পাতিলটা লাল কাপড়ে মোড়ানো থাকে) এই খাবার মোটামুটি স্বাদের এবং কম মুল্যে পাওয়া যায় বলে ছাত্র/ছাত্রী, মধ্যবিত্ত, নিম্মবিত্তদের কাছে এই খাবার খুব জনপ্রিয়। আমি নিজেও তেহারী পছন্দ করি তবে এখন আর বাসায় রান্না করতে চাই না। কারন তেহারীতে গরুর গোসত ব্যবহার করা হয়, যা আমি এখন আর খেতে পারি না। তাছাড়া বাসার অন্যরা সবাই তেহারী পছন্দ করেন।
যাই হোক, আমাদের রামপুরা এলাকায় একটা ভাল তেহারীর দোকান আছে, আল্লার দান বিরানী হাউস। এই আল্লারদান বিরানী হাউসের তেহারী মনে রাখার মত। গত বছর চারেক আগে এই দোকান প্রথম শুরু হয় তেহারী দিয়েই। এখন সারা বাংলাদেশে নাকি ৫টা শাখা হয়ে গেছে! মালিক খুলনায় নাকি বিরাট বড় হোটেল করে ফেলেছে। এই রামপুরার দোকানের ইনকাম দিয়েই! বেশ ভাল স্বাদ এবং কম টাকায় পরিমান ভাল দেয়।
চলুন, আজ আবারো তেহারী রান্না দেখে ফেলি। আগেও কয়েক বার তেহারী রান্না আপনাদের দেখিয়েছিলাম। এবারে একটু ভিন্ন করে। সামান্য এদিক সেদিক করে তবে এবারে ধাপ আকারে দেখিয়ে দেব, যাতে আপনাদের জন্য রান্নাটা আরো সহজ এবং বুঝতে সহজ হয়। আবশ্য আগেই বলে নেই, এই রান্নাটায় মশলা প্রিপারেশনের যাবতীয় কাজ করে দিয়েছেন আমার ব্যাটারী, মুল রান্না করেছি আমি নিজেই। রান্নায় (সব কিছু মিলিয়ে) সময় লেগেছিল প্রায় আড়াই ঘন্টা। খেতে খেতে প্রায় রাত সাড়ে বারটা বেজে গিয়েছিল। ঘরে ছিল একজন ছোট গেষ্ট, বুলেটের ৭ম শ্রেণীতে পড়ুয়া মামাত ভাই, বেড়াতে এসেছিল ফুফা ফুফুর বাসায়!
তেহারী রান্নায় সলিড হাড় ছাড়া গোসত হলেই ভাল এবং গোসতের টুকরা গুলো বড় না রাখাই বাঞ্ছনীয়।
১। গোসত প্রিপারেশন
২। চাউল প্রিপারেশন
৩। আলু প্রসেস
৪। মুল রান্না
উপকরণ ও পরিমানঃ (এর পূর্বে আরো বেশী পরিমানের তেহারী রান্না দেখিয়েছিলাম, এবারে কমেই রান্না)
– গরু মাংস, ১ কেজি
– পলাউ চাল, ১ কেজি
– নূতন গোল আলু, হাফ কেজি
– পেঁয়াজ কুঁচি, হাফ কাপ
– আদা বাটা, দেড় টেবিল চামচ
– রসুন বাটা, দেড় টেবিল চামচ
– জিরা গুড়া, ১ চা চামচ
– কাঁচা মরিচ বাটা, দুই টেবিল চামচ (ঝাল বুঝে)
– গোল মরিচ বাটা, আধা চা চামচ
– জয়ত্রী বাটা, হাফ চা চামচ
– জয়ফল বাটা, এক চিমটি
– বাদাম বাটা, হাফ কাপ (কাজু বাদাম বাটা হলেও চলবে)
– গরম মশলা (এলাচি কয়েকটা, দারুচিনি কয়েক পিস)
– লবন, পরিমান মত
– চিনি, হাফ চা চামচ
– কিসমিস, দুই টেবিল চামচ
– টক দই, দেড় কাপ
– কয়েকটা আস্ত কাঁচা মরিচ
– তেল, দেড় কাপ (আমি সামান্য কম তেলেই রান্না করেছি)
– পানি (গরম হলে ভাল, রান্না শুরুর আগে কিছু পানি গরম করে রেখে দিতে পারেন তবে না হলে নাই, ব্যাপার না!)
প্রস্তুত প্রনালীঃ
১। গোসত প্রিপারেশন
গোসত ভাল করে ধুয়ে টক দই দিয়ে ভিজিয়ে রাখুন আধা ঘন্টা। (বাসায় টিক দই না থাকলে এক কাপ দুধে এক টেবিল চামচ ভিনেগার দিয়ে এই দই বানিয়ে নিতে পারেন)
২। চাউল প্রিপারেশন
চাল ভাল করে ধুয়ে পানিতে পনর/বিশ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন।
৩। আলু প্রসেস
নূতন গোল আলুর খোসা ছড়িয়ে নিন (চা চামচ দিয়েই খোসা ছাড়ানো উত্তম) এবং সামান্য লবন যোগে হাফ সিদ্ধ করে ফেলুন। পানি ফেলে আলু গুলো ভাঁজার জন্য রাখুন।
এবার একটা কড়াইতে কিছু তেল নিয়ে আলু গুলো ভেজে ফেলুন। আলুর খোসায় পোড়া পোড়া ভাব এলে নামিয়ে রাখুন।
৪। মুল রান্না
তেহারী রান্নার পাত্র নির্বাচন করুন। গোসত, চাল, আলুর পরিমান মিলে জায়গা হয় এমন পাত্র নির্বাচন করুন। পাত্র ছোট হলে রান্না নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এবার পাত্র তেল গরম করুন এবং এক চা চামচ লবন যোগে পেঁয়াজ কুঁচি এবং কয়েকটা মরিচ ও দারুচিনি, এলাচি ভাল করে ভেজে নিন।
পেঁয়াজ কুঁচি নরম হয়ে এলে এবার উপরে উল্লেখিত বাকী সব মশলা/ভেজষ দিয়ে কষাতে থাকুন। এই পর্যায়ে হাফ চামচ চিনি দিয়ে দিন।
কষিয়ে নিলে তেল উপরে উঠে যাবে এবং একটা মৌ মৌ করা ঘ্রানে রান্না ঘর ভরে উঠবে।
এবার গোসত দিয়ে দিতে হবে। ভাল করে নাড়িয়ে মিশিয়ে নিন। মিনিট দশ মাধ্যম আঁচে রেখে দুই কাপ পানি দিতে হবে (গরম পানি হলে ভাল না হলে নাই)।
এবার ঢাকনা দিয়ে কষাতে হবে। এই পত্রিয়া নির্ভর করবে গোসত নরম হবার পর্যন্ত। গোসত নরম না হলে আরো এক কাপ পানি দেয়া যেতে পারে। রান্নায় মুল সময়টা এখানেই লেগে যায়।
গোসত নরম হয়ে গেলে প্রসেস করে রাখা আলু গুলো দিয়ে দিন। যাদের দুই চুলা আছে তারা এই আলুর কাজটা পাশাপাশি করতে পারেন।
এবার কিসমিস গুলো দিয়ে দিন। ভাল করে নাড়িয়ে নিন।
এবার চাল দিয়ে দিন। এবং ভাল করে মিশিয়ে নিন।
চালের উপর হাফ ইঞ্চি (পলাউ রান্নায় যেভাবে পানি দেয়া হয়) পানি দিন। পাশাপাশি আরো কিছু পানি হাতের কাছে রাখুন, লাগলে দেয়া যেতে পারে। তবে এই পর্যায়ে পানি বেশী হলে সমস্যা আছে, পানি বেশীর জন্য তেহারী ঝরঝরে না থেকে নরম এবং গলা গলা হয়ে যেতে পারে। তাই পানি দিতে সাবধানে। রান্নাঘরে ছেড়ে যাবেন না। এবার ফাইন্যাল লবন দেখুন, এই পানি একটু বেশী কটা (লবন) হলে বুঝতে হবে লবন হয়েছে। (এটা একটা অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞতাই আপনাকে বলে দেবে লবন কেমন লাগবে) যদি কম মনে হয় তবে লবন দিন। এবার ঢাকনা দিয়ে মিনিট ১৫/২০ অপেক্ষা করুন। মাঝে দুইতিন বার নাড়িয়ে দিতে ভুলবেন না। এই নাড়িয়ে দেয়ার সময় যদি পানি কম মনে হয় তবে কিংবা চাল শক্ত থাকার সম্ভবনা থাকে তবে আরো পানি দেয়া যেতে পারে এবং পানি দিয়ে ভাল করে নাড়িয়ে দিতে হবে।
এই রকম অবস্থায় এসে গেলে পাত্রের তলায় একটা তাওয়া বসিয়ে (অনেকটা দমের মত, পোলাউ এর এই রান্নায় দম দেয়াটা দেখে নিতে পারেন) দিন। এবং ডাকনা দিয়ে আরো মিনিট ১০ অপেক্ষা করুন।
মশাআল্লাহ, দেখুন কি ঝকঝকে এবং ফুরফুরা তেহারী হয়েছে। পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত। পুরা হাড়ি সহ খাবার টেবিলে নিয়ে যেতে পারেন, যার যা লাগে নিয়ে খাবে।
এভাবে আপনার যা লাগে নিয়ে নিন। সাথে শুধু জলপাই আঁচার!
আমাদের এই রান্না করা তেহারী খেয়ে আমাদের ছোট মেহমান বলছিল, খান্দানী তেহারী হয়েছে! আমাদের নামটা পছন্দ হয়, এই তেহারীকে আমরা ‘খান্দানী তেহারী’ নামেই ডাকবো! আমাদের এই ছোট মেহমানের মুখে হাসি ফুটাতে পেরে সেদিন রাতে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম।
তেহারীর আরো রান্না নিন্মের লিঙ্ক গুলোতে দেখতে পারেন, যেটা আপনার কাছে সহজ মনে হয় তা নিয়েই কাজে লেগে পড়তে পারেন।
রেসিপিঃ মোরগ তেহারী (সবার জন্য, শুধু ছবি পোষ্ট)
রেসিপিঃ শাহী তেহরী/ তেহারী (উপকরণ ও প্রস্তুত প্রনালী)
রেসিপিঃ শাহী তেহরী/ তেহারী (শুধু ছবি)
সবাইকে শুভেচ্ছা। আনন্দে কাটুক আপনাদের সময়।
কৃতজ্ঞতাঃ মানসুরা হোসেন
ঢাকাই তেহারী সিলেটের জনপ্রিয় আখনী। আমার খুব পছন্দের।
অনেকে এটাকে সামান্য হলুদ দেয়। আমি দেইনা। তবে অল্প গুড়া মরিচ দেই।
সুপার লাইক!
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ বোন।
আখনির রেসিপিটা আছে। মনে থাকে না, তা হলে একদিন রান্না করে ফেলতাম।
সামান্য হলুদ দিলে রং ভিন্ন হয়ে যাবে তাও দেখি একবার সামান্য হলুদে রান্না করে দেখবো।
শুভেচ্ছা।
LikeLike
অসাধারণ! আজই গরুর গোশ রান্না হলো নতুন আলু দিয়ে। আর একটু আগে স্ট্যাটাসটা নজরে এলে তেহেরীই ট্রাই করতাম। যাক, নেক্সট টাইম নো মিস ইন শা আল্লাহ!
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ সুমন ভাই।
আশা করি আর একদিন হয়ে যাবে।
অবশ্য গরম ভাতের সাথে আপনার রান্না করা তরকারীও চমৎকার লাগবে। গরুর গোসত এবং নূতন আলু। ওয়াও।
শুভেচ্ছা।
LikeLike
I will be there to teste sometime in
2014
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ অজ্ঞাত ভাই/বোন।
আসুন আপনার দাওয়াত থাকলো।
শুভেচ্ছা।
LikeLike
দারুণ হয়েছে!!! 🙂
তেহারি সবসময়ই আমার প্রিয় খাবার!!!
(মোবাইল দিয়ে কয়েকবার কমেন্টের চেস্টা করেও কমেন্ট করতে পারলাম না, কেন হয় এটা বুঝতে পারলাম না 😦 )
শুভেচ্ছা ও ভালোলাগা 🙂
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ ভাতিজা।
মোবাইল থেকে কমেন্ট করার দরকার নাই। মোবাইলে বাংলা লেখা কঠিন কাজ। তা ছাড়া চোখের সমস্যাও হতে পারে। মোবাইল থেকে কেন কমেন্ট হচ্ছে না এই বিষয়ে আমার কোন ধারনা নেই।
শুভেচ্ছা।
LikeLike
Vai, mela din dhore apnar ai rannaghor ami onusoron kore ascilam kintu kokho apnake dhonnobad tukun o gaapon kora hoynai…vable lojjai lage…asole kahini hoilo apnar ranna onusoroneto kono poysha khoroch jaccena…tai jokhon dorkar dekhteci, tarpor petpure kheye apnake vule jacci…
Kintu ajke r na likhe parlam na…apnar ai khadani tehari ranna korecilam…apnartar moto atota khandani na holeo mondo hoynai…asole amar r amar bariwalar dujoneri oonek shad legece…amar 4 bocorer putro o kheyece…oonek onek dhonnobad apnar amon sundor r antorik podokkheper jonno…
Valo thakun r apnar battery, bullet o notun otithi ke salam o shuvecca 🙂
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ বোন,
আপনার মন্তব্য দেখে অনেক অনেক খুশি হয়েছি। আমাদের সে উদ্দেশ্য তা পুরন হচ্ছে দেখে আমরা খুশি। কমেন্ট করেন নাই, এটা কোন ব্যাপার নয়। আপনি দেখেছেন এবং রান্না করেছেন এটা শুনেই ভাল লাগছে।
এদিকে আমাদের বাড়ীওয়ালা ভাই তেহারী ভাল বলেছেন এটা শুনে আমরা আরো আরো খুশি। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ীওয়ালা ভাইকে রান্নাঘরে নিয়ে যাবেন, আপনাদের সময় আরো ভাল কাটবে, আনন্দ পাবেন। বাড়ীওয়ালা ভাইকে কাজে উৎসাহ দিবেন, দেখবেন আপনার অনেক কাজ করে দিচ্ছেন! হা হা হা… চার বছরে ছোট মামুর জন্য আদর থাকল।
আনন্দে ভরে উঠুক আপনাদের সংসার। শুভেচ্ছা।
LikeLike
পিংব্যাকঃ রেসিপিঃ ঢাকাইয়া তেহারী (স্পেশাল) এবং ২৫ লক্ষ হিটের শুভেচ্ছা | রান্নাঘর (গল্প ও রান্না) / Udraji's Kitchen (Story a
পিংব্যাকঃ রেসিপিঃ ঢাকাইয়া তেহারী (স্পেশাল) এবং ২৫ লক্ষ হিটের শুভেচ্ছা | রান্নাঘর (গল্প ও রান্না) / Udraji's Kitchen (Story a
অনেক ভালো লাগলো মিঃ উদরাজী ভাই, ভাবীকেও শুভেচছা। আপনাদের রেসিপি গুলো আসলে অনেক মজার।
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ আপনাকে। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সাথে থাকার জন্য খুশি হলাম। শুভেচ্ছা নিন।
LikeLike
Brother Shahadat, I cooked Tehari for the first time based on this post. Tehari was tasty. Thanks for the post.
LikeLiked by 2 people
ধন্যবাদ আপনাকে, এমন শুনলে আনন্দ লাগে। চেষ্টা সার্থক মনে হয়। আনন্দে কাটুক আপনাদের সময়।
LikeLike